Friday, November 23, 2012

অনিদ্রা


অনিদ্রা রোগ বর্তমানে শহুরে ব্যস্ত এবং উচ্চ শ্রেণীর মানুষের মধ্যে বেশী পরিলক্ষিত হয়। রোগ এতই ব্যাপক যে স্বল্প ডোজের ঘুমের ঔষধে কাজ না হওয়ায় পর্যায়ক্রমে ভোজের মাত্রা বাড়িয়ে ঘুম কিনে নেওয়ার মত ঘটনা অহরহ ঘটছে। এই অনিদ্রা শারীরিক ও মানসিক বিশ্রাম হরণ করে।  ফলে দেহের সমস্ত অর্গান এর উপর চাপের সৃষ্টি হয় এবং দেহের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যহত হয়।

ঘুম শরীরের জন্যে অত্যাবশ্যক বিশ্রাম। যেটা দৈনন্দিন কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। পর্যাপ্ত ঘুম না হলে সারাদিন ঘুম ঘুম ভাব এবং ক্লান্তি অনুভ’ত হয়। ঘুম মানুষকে টেনসন মুক্ত করে মস্তিস্ক ও শরীর শান্ত এবং সজীব রাখে। ঘুমের মাত্র্ াএবং সময় মানুষে মানুষে ভিন্ন হতে পারে, তবে প্রায় মানুষের ৬-৮ ঘন্টা ঘুম স্বাভাবিকভাবে দেহ পরিচালনার জন্য যথেষ্ট।

অনিদ্রা বা কম ঘুম সাধারণত বয়স্ক মানুষের মধ্যে পরিলক্ষিত হয় এবং রাতে ২/৩ বার ঘুম ভাঙ্গার ঘটনা ঘটতে পারে। ১২ বৎসরের ছেলে মেয়েদের দিন রাতে ৯ ঘন্টা ঘুম দরকার যেটা বয়স ২০ বৎসর হলে ৮ ঘন্টায় নেমে আসে। ৪০ বৎসরে ৭ ঘন্টা এবং ৬০ বৎসর হলে ৬ ঘন্টা ঘুম স্বাভাবিক। এর ব্যতিক্রম হলে এবং চলতে থাকলে দেহের রাসায়ণিক ক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে নানা রকম রোগের সৃষ্টি করতে পারে।

লক্ষন :
ঘুমের অস্বাভাবিক পরিবর্তন, পরিমিত সময় পর্যন্ত ঘুম না হওয়া, স্মরণ শক্তি হ্রাস পাওয়া, ঘুমের নির্ধারিত কোন সময় না থাকা, আবেগ অনুভূতির পরিবর্তন হওয়া বা কমে যাওয়া। দেহের অভ্যন্তরীন কার্যক্রম স্বাভাবিক না থাকা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধাগ্রস্ত হওয়া।










কারন :
অনিদ্রার প্রধান কারণ মানসিক চাপ, দু:শ্চিন্তা, ভয়, অতিরিক্ত উত্তেজনা, রাগ এবং মাত্রাতিরিক্ত হিংসাপরায়নতা। এছাড়া ধুমপান কোষ্ঠবদ্ধতা, রাতে মাত্রাতিরিক্ত খাওয়া দাওয়া করা, অতিরিক্ত চা ও কফি পান করা এবং অভুক্ত অবস্থায় রাতে ঘুমাতে যাওয়া এছাড়া অনিদ্রা নিয়ে দু:শ্চিন্তা করলেও ঘুমের ব্যাঘাত হতে পারে।

নিরাময়:
এর থেকে পরিত্রান পেতে হলে প্রথমেই জানতে ঘুম সৃষ্টি হয় কিভাবে এবং স্থায়ীকাল কিভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। আমরা জানি মানব দেহে দুই ধরনের গ্লান্ড্ বা গ্রন্থি আছে। যেমন-এনড্রোক্রাইন বা নালী বিহীন গ্রন্থি এবং এক্সোক্রাইন বা নালীযুক্ত গ্রন্থি। এনড্রোক্রাইন গ্রন্থি আছে দশ ধরনের দেহের দশ জায়গায় অবস্থিত। যাদের প্রধান কাজ শরীরের বিভিন্ন রাসায়নিক ক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় পরিমানে হরমোন নি:সরন করা  এবং  এক্সোক্রাইন গ্রন্থি আছে পাঁচ প্রকার যার প্রধান কাজ শরীর থেকে অপ্রয়োজনীয় পানি বা পানিয় দ্রব্য শরীর থেকে বার করে দেয়ার জন্য সদা নিয়োজিত থাকা। দেহের প্রতিটি এনড্রোক্রাইন গ্রন্থি শরীরের প্রতি মুহুর্তের রাসায়নিক কর্মকান্ড পরিচালনা করে থাকে। ঘুমে আছন্ন হয়ে ঘুমিয়ে যাওয়া এবং ঘুম থেকে স্বয়ংক্রীয়ভাবে জেগে ওঠার কাজটা দেহের যে গ্রন্থি করে থাকে তার নাম পিনিয়াল গ্রন্থি যাকে বিজ্ঞানীগণ নাম দিয়েছে তৃতীয় নয়ন হিসাবে। কারন এই গ্রন্থি আলোতে সংবেদনশীল। এই গ্রন্থি এক ধরনের হরমোন নি:স্বরন করে যাকে বলা হয় মেলাটোনিন। এই মেলাটোনিন নি:স্বরন হওয়ার সাথে সাথে দেহের মধ্যে এক ধরনের রাসায়নিক ক্রিয়া শুরু হয় তখন মানুষ ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। এই গ্রন্থিটি অন্ধকারে ক্রিয়াশীল। সাধারত সন্ধ্যা হওয়ার পর থেকে এর নি:সবণ শুরু হয় যা ভোরের আলো না দেখা পর্যন্ত চলতে থাকে। ভোরের আলো দেখামাত্র এর নি:স্বরন বন্ধ হয়ে যায় তখন ঘুমন্ত মানুষ সয়ংক্রিয়ভাবে জেগে ওঠে। শহুরে মানুষ এবং গ্রামের মানুষের ঘুমের মধ্যে অনেক তফাৎ দেখা যায়। যেমন-শহুরে মানুষ অনেক রাত পর্যন্ত জেগে টিভি দেখে বা বই পড়ে যার কারনে তাদের পিনিয়াল গ্রন্থি আলোর কারনে ক্রিয়াশীল হতে পারে না।  পক্ষান্তরে গ্রামের মানুষেরা সন্ধ্যায় অন্ধকার হয়ে আসলে তাদের পিনিয়াল গ্রন্থি থেকে মেলাটোনিন হরমোন নি:স্বরন হতে শুরু করে এবং তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যায়। শেষ রাতে ভোরের আলো দেখা গেলেই পিনিয়ালের নি:স্বরন বন্ধ হয়ে যায় এবং ঘুমন্ত মানুষ এমনিতেই জেগে যায়। এটাকেই বলে নিদ্রার দেহ ঘড়ি।  একবার যদি আপনার দেহ ঘড়ির কার্য্যকারীতা কমে যায় তখন ঘুম আসার জন্য আপনার ভিতর অস্থিরতা দেখা দেবে এবং মানসিক চাপের সৃষ্টি হবে। এর থেকে পরিত্রান পেতে অনিদ্রা আক্রান্ত ব্যাক্তি ঘুমের পিলের দায়স্থ হয়। এভাবে আক্রান্ত ব্যাক্তি ঘুমের পিলের প্রতি নির্ভর করতে থাকে এবং অভ্যস্থ হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় শরীরে নানা রকম পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।

যেমন ঠিকমত হজম না হওয়া, চামড়ার উপর র‌্যাশ দেখা দেওয়া, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া, শ্বাসতন্ত্রের কার্যকারিতা হ্রাস পাওয়া, ক্ষুধামন্দা দেখা দেওয়া, কিডনি, লিভার এক কার্যক্ষমতার উপর চাপের সৃষ্টি করে নানারকম রোগের উপসর্গ দেখা দেওয়া এবং রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া।

এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে প্রথমেই ঘুমের সময় নির্ধারণ করতে হবে। ঘুম না আসলেও প্রতি রাতে নির্ধারিত সময়ে ঘুমের পরিবেশ তৈরি করে বিছানায় যেতে হবে এবং ভোরে নির্ধারিত সময়ে বিছানা ছেড়ে উঠতে হবে। এটা করতে থাকলে কিছুদিনের মধ্যেই স্বাভাবিক ঘুম হবে। মনে রাখতে হবে, শেষ রাতের ৪ ঘন্টা অপেক্ষা মধ্যরাতের পূর্বে ২ ঘন্টা গভীর ঘুম দেহের জন্য অত্যন্ত উপকারী। প্রথম রাতে অফিসিয়াল কাজ কিংবা টিভি দেখে মধ্যরাতের পরে ঘুমাতে যারা অভ্যস্ত তাদের দেহ সুস্থ থাকে না।

গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ক্রমাগত অনিদ্রায় ভোগে এবং ঘুমের পিল খায় তাদের দেহে প্রয়োজনীয় ভিটামিন (বি কমপ্লেক্স, সি এবং ডি ভিটামিন) এবং মিনারেল (ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, পটাসিয়াম  এবং জিঙ্ক) এর ঘাটতি দেখা দেয়, এবং ঘুম আসার ম্যাকানিজম এর কার্যকারিতা হ্রাস পায়। ফলে দেহের স্বাভাবিক কার্য্যক্রম ব্যাহত হয়। একটা সাধারণ ডায়েটকে কিছুটা পরিবর্তন করে শরীরের উপযোগী করে খাওয়া শুরু করলে কিছু দিনের মধ্যেই অনিদ্রার রাহুগ্রাস থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। এজন্যে খাবারের মধ্যে অবশ্যই সাদা ময়দা এবং এর দ্বারা প্রস্তুত খাবার, সাদা চিনি দিয়ে যে কোন খাবার, চা, কফি, চকলেট, কোলাপানীয়, মদজাতীয় পানীয়, তৈলাক্ত এবং তেলে ভাজা খাবার, প্রিজারভেটিভ এবং রং দেওয়া খাবার এবং বেশী লবনাক্ত খাবার মেনু থেকে বাদ দিতে হবে।

প্রচলিত খাবারগুলি একটুখানি পরিবর্তণ করে নি¤েœর খাবারগুলি খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুললে দ্রুত সুফল পাওয়া যাবে।

সকালের নাস্তা - খালি পেটে এক গ্লাস কুসুম গরম পানিতে এক চা চামচ লেবুর রস দিয়ে খেতে হবে। এর আধা ঘন্টা
পর যে কোন একটা মৌসুমী রসাল ফল। পরে নাস্তায়  ভ’ষিসমেত আটার রুটি বা খই সঙ্গে ঘরে
পাতা টক দই এবং আখের গুড়।
বেলা ১১-১২ টা - যে কোন একটা ফল।
দুপুর - ভাত, শাকসবজি, মুগের ডাল, সয়াবিন ভর্তা  শেষে ঘরে পাতা টক দই আধা কাপ।
রাতে - সবজি, সালাদ, রুটি এবং এক টুকরা মাছ / মুরগী
শোবার পূর্বে - এক কাপ গরম দুধ ডায়াবেটিকস না থাকলে ১৫/২০ টা কিসমিস সহ খেতে হবে।

এছাড়া শোবার ঘরটা হতে হবে সুন্দর পরিপাটি । ঘর সম্পূর্ন অন্ধকার করে নিতে হবে যাতে পিনিয়াল গ্রন্থির হরমোন নি:স্বরন বাধাগ্রস্থ না হয়। শোয়ার সময় দিনের কার্যক্রমের চিন্তা করা থেকে বিরত থাকতে হবে। চিৎ হয়ে না শুয়ে যে কোন এক পাশ হয়ে শুলে কিছুক্ষন এর মধ্যেই ঘুম আসবে। ঘুমানোর পূর্বে কিছুক্ষন নি:শ্বাস প্রস্বাশের ব্যায়াম করলে ঘুম আসতে সাহায্য করে। তাছাড়া রাতের খাওয়ার পর ১৫-২০ মি: হাটলে ঘুমের বড়ি খাওয়ার মত অনুভুতি পাওয়া যায়।

নিয়মিত স্বাস্থ্য চর্চা যেমন ভোরে হাঁটা কিংবা যোগ ব্যায়াম, রাতে নি:শ্বাস নিয়ন্ত্রনের ব্যায়াম এবং রাতের খাওয়ার পর ১৫/২০ মি: হাটলে অনিদ্রা রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। কাজ থেকে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে গরম পানিতে পা দুটি ডুবিয়ে ১৫ মি: থাকলে শরীরের অবসাদ অনেকটা কমে যায়।

রাতে শোয়ার পূর্বে দুই পায়ের তলায় রসুন তেল কিছুক্ষণ মালিশ করে কুসুম গরম পানিতে গোসল করে ঘুমাতে গেলে ভাল ঘুম হয়।

এছাড়া চেষ্টা করতে হবে যেন সবসময় প্রফুল্ল চিত্তে টেনশনমুক্ত দিন অতিবাহিত করা যায়। যদিও বর্তমান সময়ে এটা বেশ কঠিন তবুও চেষ্টা করতে কোন ক্ষতি নেই। হয়ত চেষ্টা করতে করতে মনের এবং শরীরের নিয়ন্ত্রণ এমনিতেই এসে যাবে।


No comments:

Post a Comment